এই প্রবন্ধটি ১১ই জানুয়ারি, ২০২৫-এ আমাদের চ্যানেল Talks & Docs-এ প্রকাশিত “হাড়গিলের হালহদিশ” ভিডিয়োটির খসড়া স্ক্রিপ্ট। সময় পেলে অবশ্যই ভিডিয়োটা দেখে নিন, আর মতামত জানান!
পুরনো কোলকাতার ইতিহাস নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম বছর কয়েক আগে। বই… পুরনো ছবি… পুরনো ছবি। তো, সেরকম ঘাঁটতে ঘাঁটতেই… একটা বইটা চোখে পড়লো। “Life in India or Madras, the Neilgherries, and Calcutta”, মার্কিন মিশনারি জন ওয়েলশ ডুলস-এর লেখা। ১৮৫৫ সালের বই, মানে মহাবিদ্রোহের দু’বছর আগে। পুরো বইটাতেই পুরনো ভারতের স্কেচ। শেষের দিকে পৌঁছে হঠাৎ এই ছবিটা চোখে পড়লো।
গভর্নমেন্ট হাউসের স্কেচ। সে’সব ঠিক আছে, কিন্তু ভাল করে দেখুন। পুরো বিল্ডিঙটার মাথায় অনেকগুলো পাখি বসে আছে। এমনকি গেটের ওপরেও বসে আছে। এবং পাখিগুলো বিশাল, gigantic. এই এক পাখির ছবি আরো এক শিল্পী এঁকেছিলেন। বিখ্যাত স্কটিশ শিল্পীর আঁকা ওই একই জায়গার ছবি, যদিও এই এনগ্রেভিংটা অন্য একজনের করা। লক্ষ্য করুন, পাখিগুলো এটাতেও দিব্যি বসে আছে। সর্বত্র, অজস্র। এমনকি উড়ছেও।
জন সাহেবের বই দু’পাতা ওলটাতেই উত্তর পেয়ে গেলাম। “Adjutant”. অর্থাৎ কী না, greater adjutant stork. অর্থাৎ, হাড়গিলে। এত ভণিতা বোধ হয় না করলেও হল, ভিডিও টাইটেলেই তো বড়-বড় করে লেখা রয়েছে “হাড়গিলে”। যাক গে! হাড়গিলের কথা তো অবশ্যই পড়েছি। ফেলুদাই বলেছে, “সাড়ে চার ফুট লম্বা পাখি। রাস্তায় ময়লা খুঁটে খুঁটে খেত। এখন যেমন দেখছেন কাক চড়ুই, তখন ছিল হাড়গিলে। গঙ্গার জলে মড়া ভেসে যেত, তার উপর চেপে দিব্যি নৌসফর করত।” কিন্তু, হাড়গিলের কথা শুনেছি, পড়েছি। কিন্তু, দেখিনি। কারণ, দেখার চান্স খুব কম। কিন্তু, কেন? হাড়গিলেরা গেল কোথায়?
ম্যাডাগাস্কার আর মরিশাসে একসময় এমনই এক পাখি এক সময় ঘুরে বেড়াতো। তারপর নাবিকরা ডোডো শিকার শুরু করলেন। অন্য জন্তুজানোয়ারের পেটেও গেল কিছু ডোডো। আর, তারপর, poof! ডোডো হাওয়া। এগজ্যাক্টলি কীভাবে ডোডোরা গত হলেন, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কিন্তু, হাড়গিলেরা বহু দশক ধরে সেই পথেরই পথিক। হাড়গিলে, greater adjutant stork. তাদের সংখ্যা এতটাই কম যে আসামে বছর কয়েক আগে আর্টিফিশিয়াল হাড়গিলে ব্রিডিং-এর প্রজেক্ট শুরু হয়েছে। এখন বিহার, আসাম, আর… ক্যাম্বোডিয়ার কিছু অঞ্চলে পাওয়া যায় এদের। অথচ এক সময়, বহু বছর আগে, মানে বহুউউউউ বছর আগে… কয়েকশো বছর আগে এরা বাংলায় গিজগিজ করতো। এই যে লোকাল নেম হাড়গিলে, মানে এরা হাড় গিলতো। স্ক্যাভেঞ্জার বার্ড। তখন স্বাভাবিকভাবেই আর্বানাইজেশন শুরু হয়নি। তাই এদের রীতিমত… রাস্তাঘাটে দ্যাখা যেত। আর এদের স্বভাবচরিত্র? জন সাহেব যা বলছেন, লম্বা-লম্বা পা, গলা আর বিশাল পাউচ ঝুলছে গলার কাছ থেকে। এরা মৃত ইঁদুর, এমনকি একটা গোটা বেড়ালকেও মুখে পুরতে পারতো। বিশাল বড়ো হাঁ!
জেমস ফ্রেজারের ছবিটা যেমন ১৮১৯-এর। কিন্তু, এটা আসলে রেলেটিভলি রিসেন্ট (যদিও দু’শো বছরের পুরনো)। এর আগেও, মানে খোদ বাবরের আত্মজীবনীতেও এদের উল্লেখ আছে। বাবরনামা। মানে, ওই… ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে। সেখানে একে “ডিং” (ding) বলা হয়েছে। ব্রিটিশদের আসার সময়ও এরা ছিল। এবং শুধু যে ছিল, তা নয়। ছবি দেখে মনে হয়, মানুষের সামনে হাঁটাচলা করতে এদের ভয়ডর লাগতো না। অবশ্য এরা স্ক্যাভেঞ্জার বার্ড!
এই হচ্ছে সেই সময়কার ফোর্ট উইলিয়াম।
সুইডিশ জীববিজ্ঞানী কার্ল সান্ডেভ্যাল বলছেন, এখানেই সেসময় প্রচুর সংখ্যায় হাড়গিলে পাওয়া যেত, বিশেষ করে ছাদে। সান্ডেভ্যাল হাড়গিলের ওড়াউড়ির পদ্ধতি কিছুটা বর্ণনা করেছেন। যাই হোক, একসময় কলকাতা শহরের কোট অফ আর্মসেও এদের দ্যাখা পাওয়া যেত।
তাহলে এরা হাওয়া হয়ে গেল কী করে? পুরোপুরি ডোডোর দশা হয়নি বটে, তাও! ওয়েল, ব্রিটিশ আমলে যে নগরায়ণ শুরু হল, তার একটা ভূমিকা আছে বটে। কিন্তু, প্রাকৃতিক কারণও ছিল বটে। বেবি হাড়গিলেরা নাকি দুমদাম বাসা থেকে পড়ে যায় অনেক সময়, এবং ইঞ্জিওরড হয়। তারপর খেতে না পেয়ে অনেক সময়ে মারা যায়।
কিন্তু যেটা হল আসলে, ব্রিটিশ আমলে র্যাপিড আর্বানাইজেশন শুরু হল, জলাভূমি কমলো, ল্যান্ডস্কেপ পালটে গেল। মানে, হাড়গিলেদের ফিডিং হ্যাবিটাটের বারোটা বেজে গেল। অবশ্য চেঞ্জ জিনিসটা তো ইনএভিটেবল। এক সময় কোলকাতার কাছেই বাঘ পাওয়া যেত। মানে শুধু দক্ষিণে না, ইভেন খানিকটা উত্তরের দিকেও। এই যেমন Bengal District Gazetteers (1912)-এ পড়ছি, গুপ্তিপাড়ায় লেপার্ড পাওয়া যেত। ১৮৩০ নাগাদ এসব অঞ্চলে শেষবার বাঘ দ্যাখার কথা রিপোর্টেড, সাতগাঁও-তে। মানে, সপ্তগ্রামে।
যাই হোক, নগরায়ণের ফলে ডেন্স জঙ্গল কমে গেল। স্ক্যাভেঞ্জিং বার্ডদের খাদ্যসংকট শুরু হল। এবং হাড়গিলেরা ইতিহাস বইতে জায়গা পেল। এই হল গল্প। এদের লুপ্ত হওয়ার গল্পটা ডোডোর মতো ইন্টারেস্টিং নয়, কিন্তু এরা আসলে ক্যামন ছিল… সেটা কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং। কিন্তু, নানা রকমের কন্ট্রাডিকশনের রেসোলিউশনের মাধ্যমে, বিশেষ করে উৎপাদনের পদ্ধতির পরিবর্তনের মাধ্যমে যেভাবে সভ্যতা এগোয়… তাতে হাড়গিলে উবে গ্যাছে।
References:
- Life in India or Madras, the Neilgherries, and Calcutta (1855). John Welsh Dulles.
- গোরস্থানে সাবধান! (১৯৭৯ – গ্রন্থ)। সত্যজিৎ রায়।
- https://indianexpress.com/article/north-east-india/assam/a-home-for-the-hargila-an-artificial-breeding-project-aims-to-help-the-endangered-stork-6236277/
- The Babur-nama in English (Memoirs of Babur) by Babur. 1922 translation by Annette Susannah Beveridge.
- M. Sundevall on the birds of Calcutta.
- Bengal District Gazetteers (1912).
Leave a Reply